
বিভিন্নভাবে আল্লাহ তায়ালার জিকির করা যায়। তবে অনন্য জিকির হলো কোরআন তেলাওয়াত করা। আল্লাহর অপূর্ব কথামালাকে নিজের মুখে আওড়াতে পারার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে, বান্দার আমলের পাল্লাকে ভারি করে এবং এর মাধ্যমে ঈমানের মাত্রা বৃদ্ধি পায়\
ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা মানুষ আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি। সে হিসেবে মানুষ মহান স্রষ্টাকে স্মরণ করবে এটিই স্বাভাবিক। এই স্মরণ করাই হলো আল্লাহর জিকির, যা কোনো সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। কোনো বিশেষ অবস্থা, শর্তাবলি ও নিয়মনীতি দ্বারা আবদ্ধ নয়। আল্লাহর জিকিরই হলো সর্বোত্তম ইবাদত। আল্লাহ তায়ালা বেশি বেশি জিকির করতে বান্দার প্রতি উন্মুক্ত আহ্বান করেছেন। জিকির আল্লাহর অনুগ্রহ, ফেরেশতাদের দোয়া, হেদায়াত ও জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম।
আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিন! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারাও তোমাদের জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করে অন্ধকার থেকে তোমাদের আলোয় আনার জন্য এবং তিনি মোমিনদের প্রতি পরম দয়ালু।’ (সূরা আহজাব : ৪১-৪৩)। ‘আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ, অধিক স্মরণকারী নারীÑ এদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।’ (সূরা আহজাব : ৩৫)।
বিভিন্নভাবে আল্লাহ তায়ালার জিকির করা যায়। তবে অনন্য জিকির হলো কোরআন তেলাওয়াত করা। আল্লাহর অপূর্ব কথামালাকে নিজের মুখে আওড়াতে পারার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে, বান্দার আমলের পাল্লাকে ভারি করে এবং এর মাধ্যমে ঈমানের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। কোরআন তেলাওয়াত করার নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করা হয় কিতাব হতে তুমি তেলাওয়াত করো।’ (সূরা আনকাবুত : ৪৫)।
হজরত আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.) কে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে কিছু নসিহত করুন। নবী (সা.) বললেন, ‘তোমার উচিত কোরআন তেলাওয়াত ও মহামহিম আল্লাহর জিকির করা, কেননা এর মাধ্যমে তুমি আকাশবাসীদের কাছে আলোচিত হবে এবং এটা দুনিয়ায় তোমার জন্য নুর হবে।’ (শু’য়াবুল ঈমান : ৪৯৪২)। এছাড়াও রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের সর্বোত্তম ইবাদত হলো কোরআন তেলাওয়াত।’ (কানযুল উম্মাল : ২২৬৪)।
কোরআন তেলাওয়াতের ফজিলত কোরআন তেলাওয়াতের ফজিলত বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহর কিতাব (কোরআন) তেলাওয়াত করে; নামাজ কায়েম করে; আর আমি তাদের যা দান করেছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন এক ব্যবসা আশা করে, যা নষ্ট হবে না। এজন্য যে, তিনি তাদেরকে তাদের কর্মফল পুরোপুরি দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও বেশি দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, প্রতিদানকারী।’ (সূরা ফাতির : ২৯-৩০)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘মোমিন তো তারাই, যাদের কাছে আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় কম্পিত হয় এবং যখন তাঁর আয়াত পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের ওপরই নির্ভর করে।’ (সূরা আনফাল : ২)।
কোরআন তেলাওয়াত করা হলে এর প্রতিটি হরফের বিনিময়ে দশটি করে নেকি অর্জিত হয়। আর মুখস্থ করার দ্বারা জান্নাতে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। হজরত উকবা বিন আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা একদিন সুফফায় ছিলাম; এমন সময় রাসুল (সা.) আমাদের কাছে এসে বললেন, তোমাদের মাঝে কেউ কি এটা পছন্দ করে যে, সে প্রতিদিন সকালে পাহাড়ি উপত্যকায় বা আকিক পাহাড়ে গিয়ে সেখান থেকে দুটি উট নিয়ে আসবে? এই কাজে কোনো গোনাহও হবে না; আবার আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নও হবে না (কারণ, সে প্রাণীগুলো জবরদখল করে আনবে না)।
আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের সবাই তো এটা পছন্দ করে। রাসুল (সা.) বললেন, তোমাদের যে ব্যক্তি সকাল বেলায় মসজিদে এসে কোরআনের দুটি আয়াত শিক্ষা করে কিংবা তেলাওয়াত করে তবে তা দুটি উটের চেয়েও উত্তম। তিনটি আয়াত তিনটি উটের চেয়ে উত্তম, চারটি আয়াত চারটি উটের চেয়ে উত্তম। এভাবে যতটি আয়াত তেলাওয়াত করবে, তা ততটি উটের চেয়ে উত্তম হবে।’ (মুসলিম : ১৯০৯)।
কোরআন তেলাওয়াতের আদব
কোরআন তেলাওয়াতের সময় অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নিম্নোক্ত আদবগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমনÑ
১. আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরআন তেলাওয়াত : ইখলাসের সঙ্গে শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য কোরআন তেলাওয়াত করা। পার্থিব কোনো বিষয়কে এ ব্যাপারে প্রাধান্য না দেওয়া। হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছেÑ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন বিচারকার্য পরিচালনা করার জন্য আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের কাছে নেমে আসবেন। এ সময় সব মানুষ আল্লাহর সামনে নতজানু হয়ে থাকবে।
সবার প্রথম বিচারের জন্য যাদের ডাকা হবে তারা হলো, যে কোরআনকে বক্ষে ধারণ করেছে। যে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে। এবং যে প্রচুর সম্পদের অধিকারী ছিল। আল্লাহ তায়ালা প্রথমে কোরআন তেলাওয়াতকারীকে বলবেন, আমার রাসুলের ওপর যা নাজিল করেছিলাম তা কি তোমাকে আমি শিক্ষা দেইনি? সে বলবে, হ্যাঁ প্রভু, শিক্ষা দিয়েছিলেন। তখন আল্লাহ জিজ্ঞাসা করবেন, আমি তোমাকে যা শিক্ষা দিয়েছিলাম সে অনুযায়ী তুমি কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি তো রাত্রি ও দিনের অধিকাংশ সময় নামাজে দ-য়মান হয়ে কোরআন তেলাওয়াত করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ।
ফেরেশতারাও বলবে, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি তো এজন্য কোরআন তেলাওয়াত করতে যাতে মানুষ তোমাকে কারি বলে সম্বোধন করে। আর এটা তোমাকে বলাও হয়েছে। … (আবু হুরায়রা (রা.) বলেন,) এরপর রাসুল (সা.) আমার হাঁটুতে চাপড় দিয়ে বললেন, হে আবু হুরায়রা! কেয়ামতের দিন এই তিন ব্যক্তিকে দিয়েই প্রথম জাহান্নামের আগুন জ্বালানো হবে।’ (তিরমিজি : ২৩৮২)।
২. পবিত্র অবস্থায় কোরআন তেলাওয়াত : যথাসাধ্য পাক-পবিত্র হয়ে কোরআন তেলাওয়াত করতে হবে। পবিত্র অবস্থা ছাড়া কোরআন স্পর্শ করা যায় না। আল্লাহ বলেন, ‘যারা পূত-পবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না।’ (সূরা ওয়াকিয়া : ৭৯)।
৩. সুন্দর আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াত : সুন্দর আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াত করা উত্তম। নবী (সা.) মানুষকে সুন্দর করে সুন্দর আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। হজরত বারা বিন আজেব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.) কে এ কথা বলতে শুনেছি, তোমরা কোরআনকে সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াত করো, কেননা সুন্দর আওয়াজ কোরআনের সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করে।’ (শুয়াবুল ঈমান : ২১৪১)।
কোরআনের মুক্তামালায় জীবনকে সাজিয়ে নিতে আসুন যারা সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন পড়তে জানি না তারা কোরআন শেখার দৃঢ়সংকল্প নিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা শুরু করি। নিয়মিত তেলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তুলি এবং তেলাওয়াতের পাশাপাশি কোরআনের মর্মবাণী বোঝার জন্য তাফসির ও হাদিস অধ্যয়নসহ হক্কানি আলিমদের সাহচার্য লাভ করি। একই সঙ্গে কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী সুন্নাহ মাফিক আমল করে কোরআনের সঙ্গে সুমধুর সম্পর্ক গড়ে তুলি।